শিরোনাম: "ম্যানহাটনের সন্ধ্যাবেলা"
নিউইয়র্ক শহরের ব্যস্ততা যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে পিকে’র জীবনে। সে একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ার—ম্যানহাটনের একটি বড় কর্পোরেট অফিসে কাজ করে। সকাল আটটার ট্রেন ধরার তাড়া, দুপুরে তাড়াহুড়ো করে খাওয়াটা, আর সন্ধ্যায় ক্লান্ত চোখে ঘরে ফেরা—সব কিছু যেন এক ঘূর্ণির মতো চলছে। এই শহরে মানুষ আছে, আলো আছে, শব্দ আছে—কিন্তু ভালোবাসা? তা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
পিকে নিউইয়র্ক এসেছে চার বছর আগে। বাংলাদেশে রেখে এসেছে মা-বাবা, কিছু না বলা স্বপ্ন আর ফেলে আসা এক বন্ধুত্ব—যার নাম প্রিয়া।
প্রিয়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, খুব চঞ্চল আর প্রাণবন্ত। পিকে আর প্রিয়া দুজনেই জানতো—তাদের বন্ধুত্বের গভীরে এক অদৃশ্য ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। কিন্তু কেউ বলেনি কিছু। পিকে চলে আসে আমেরিকায়, আর প্রিয়া থেকে যায় ঢাকায়।
চার বছর পরের গল্প এটি। হঠাৎ একদিন, নিউইয়র্কের স্টারবাক্স ক্যাফেতে বসে পিকে ল্যাপটপে কাজ করছিল। ঠিক তখনই দরজা দিয়ে একজন ঢুকলো। পিকে মুখ তুলে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল। যেন সময় থেমে গেছে।
—"প্রিয়া?"
—"পিকে?"
দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক। তারপর হেসে উঠল।
—"তুই এখানে?"
—"আমি তোকে জিজ্ঞেস করব!"
প্রিয়া নিউইয়র্ক এসেছে মাস ছয়েক হলো—ফ্যাশন ডিজাইনে মাস্টার্স করছে। থাকার জায়গা ব্রুকলিনে, আর ক্লাস হয় ম্যানহাটনে।
এরপর শুরু হলো নতুন করে পরিচয়।
স্টারবাক্সের সেই দিনটা যেন একটি মোড় ছিল পিকে’র জীবনে। প্রিয়া তার জীবনে আবার ফিরে এসেছে—এই শহরের কংক্রিটের ভিড়ে যেন নতুন একটা আলো জ্বলে উঠেছে।
দ্বিতীয় পর্ব: "শহরের ভিড়ে একান্ত সন্ধ্যা"
পিকে আর প্রিয়ার দেখা এখন নিয়মিত। সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটা, টাইমস স্কয়ারে রাতের আলো দেখা, আর ব্রুকলিন ব্রিজ ধরে গল্পের ছলে হারিয়ে যাওয়া।
প্রিয়া হাসতে হাসতে বলে,
—"এই শহরটা তোকে একদম বদলে দিয়েছে, পিকে। আগের মতো কেমন নিরিবিলি না!"
পিকে বলে,
—"তুই তো সেই আগেরই আছিস—হাসলে চোখে তারা পড়ে, বুঝিস?"
প্রিয়া একটু লজ্জা পায়, আর পিকে’র চোখে গভীর কিছু খুঁজে ফেরে।
এক সন্ধ্যায় পিকে প্রিয়াকে নিয়ে গেল রিভার সাইড পার্কে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, হাডসন নদীর পাড়ে বসে দুজন।
পিকে বলে,
—"তুই জানিস, আমি তোকে একটা কথা অনেক বছর ধরেই বলতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি।"
প্রিয়া চুপ করে থাকে। হাওয়ায় তার চুল উড়ছে।
—"আমি তোকে ভালোবাসি, প্রিয়া। সেই প্রথম দিন থেকে।"
প্রিয়া চোখ বন্ধ করে। তারপর ধীরে বলে,
—"জানি, পিকে। আমিও তোকে ভালোবাসি। সবসময়ই বাসতাম।"
এই স্বীকারোক্তির পরে, যেন নিউইয়র্কের সব আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তৃতীয় পর্ব: "বাস্তবতার ধাক্কা"
ভালোবাসা যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবতা ততটা নয়। প্রিয়ার ভিসার মেয়াদ ছয় মাস পর শেষ হচ্ছে। সে চায় নিউইয়র্কে থেকে যেতে, কিন্তু সেটার জন্য স্পনসর দরকার। পিকে বলে,
—"আমার কোম্পানিতে চেষ্টা করব।"
কিন্তু কোম্পানির নীতিমালায় সমস্যা—ফ্যাশন বা ডিজাইন বিভাগের জন্য তারা স্পনসর করে না।
প্রিয়ার চোখে জল চলে আসে।
—"তুই জানিস, আমি আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই না। এখানেই আমার স্বপ্ন গড়েছি।"
পিকে ভাবে—সম্ভব কি কিছু একটা করা?
সে একদিন প্রিয়াকে ডিনার ডেটে নিয়ে যায় হাডসন নদীর পাশে এক রেস্তোরাঁয়। খাওয়া শেষে বলল,
—"চল, বিয়ে করি। লিগ্যাল ভাবে বিয়ে করলে তুই স্টে পারমিট পাবি।"
প্রিয়া কিছুক্ষণ চুপ।
—"এইটা কি শুধু ভিসার জন্য বলছিস?"
—"না প্রিয়া, এটা আমি চাই কারণ তুই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।"
প্রিয়া ধীরে মাথা নেড়ে রাজি হয়।
চতুর্থ পর্ব: "বাঁধনের শুরু"
ছোট করে কোর্ট ম্যারেজ হয় পিকে আর প্রিয়ার। দুজনের বন্ধুরা আর সহপাঠীরা সাক্ষী থাকে। এরপর থেকে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়।
প্রিয়া ধীরে ধীরে নিজের জায়গা খুঁজে পায়—একটি ফ্যাশন হাউসে ইন্টার্নশিপ পায় এবং তাদের প্রজেক্টে কাজ শুরু করে।
পিকে’র জীবনেও পরিবর্তন আসে। সে অফিস থেকে ফেরার পর প্রিয়াকে রান্নাঘরে দেখে আর ভাবে—এই শান্তিটুকুর জন্যই তো সে নিউইয়র্কে থাকতে চেয়েছিল।
এক রাতে, প্রিয়া তার ডিজাইন করা একটি পোশাক দেখিয়ে বলে,
—"তুই আমার মডেল হবি?"
—"আমি?"
—"হ্যাঁ, ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছুই তো করে, তাই না?"
পিকে হেসে ওঠে।
পঞ্চম পর্ব: "মেঘলা সকাল, রোদেলা বিকেল"
সবকিছুই ভালো চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন, প্রিয়ার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে বাংলাদেশে যেতে হয় তাড়াতাড়ি। পিকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে এসে বলে,
—"ফিরে আসবি তো?"
প্রিয়া বলে,
—"তুই আছিস তো আমার জন্য, আমি কেন ফিরবো না?"
দু মাস কেটে যায়। প্রিয়া বাংলাদেশে তার বাবার পাশে থাকে। ফোনে কথা হয় প্রতিদিন, কিন্তু দূরত্ব বেড়ে চলে মনে।
এক রাতে প্রিয়া ফোন করে বলে,
—"তুই কি আমাকে মিস করিস, পিকে?"
—"প্রতিটা নিঃশ্বাসে করি।"
এরপর একদিন, হঠাৎ প্রিয়া দরজার সামনে।
পিকে দরজা খুলেই স্তব্ধ—
—"তুই!"
—"তুই না বলেছিলি আমি ফিরে আসব?"
প্রিয়া নিউইয়র্ক ফিরেছে চিরদিনের জন্য। তারা দুজন মিলেই এখন স্বপ্ন গড়ে।
শেষ পর্ব: "ভালোবাসা নিউইয়র্কের রাস্তায়"
পিকে আর প্রিয়া এখন একসাথে নিউইয়র্কে। একদিকে চাকরি, আরেকদিকে ভালোবাসার সংসার। কখনো উইন্টার গার্ডেন, কখনো সেন্ট্রাল পার্ক—তাদের ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে শহরের প্রতিটি কোণে।
এক সন্ধ্যায়, তারা আবার সেই পুরনো স্টারবাক্সে বসে। প্রিয়া বলে,
—"এইখানে তো আমাদের নতুন জীবনের শুরু।"
পিকে হেসে বলে,
—"তাই তো! তোর জন্য এই শহরটা আমার কাছে আজও প্রেমের শহর।"
প্রিয়া মাথা কাঁধে রেখে চুপচাপ বসে থাকে। বাইরে স্নো পড়ছে। শহর কাঁপছে ঠাণ্ডায়। আর তাদের ভালোবাসা গলে যাচ্ছে সেই স্নো’র মতোই—নরম, গভীর, চিরন্তন।
শেষ কথা:
এই গল্পটা শুধু নিউইয়র্ক শহরের নয়, এটি সেইসব ভালোবাসার গল্প যারা দূরত্ব, সময় আর বাস্তবতার মধ্যেও টিকে থাকে—হৃদয়ের গোপন বন্ধনে বাঁধা পড়ে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন